জার্মানির মূলধারায় বর্ণবাদের উত্থান

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানির হানাউ শহরে দুটি পৃথক সিসা বারে এক উগ্র-ডানপন্থী ব্যক্তি বন্দুক হামলা চালান। তিনি প্রথমে মিডনাইট সিসা বারে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালান, সেখান থেকে বেরিয়ে এরিনা বার অ্যান্ড ক্যাফেতে ঢুকে কিছুক্ষণ তাণ্ডব চালান। 

ওই দুটি হামলায় অন্তত আটজন নিহত হন। আহত হন আরো পাঁচজন। হতাহতদের সবাই অভিবাসী। 

পুলিশের তল্লাশি অভিযানের পর প্রকাশ্যে আসে ৪৩ বছর বয়সী হামলাকারী টোবিয়াসের পরিচয়। ভোরে তার ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে টোবিয়াস ও তার মায়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হয়- মাকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন টোবিয়াস। জার্মান কর্তৃপক্ষ জানায়, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী মতাদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি ওই হামলা চালান। হামলার আগে তিনি অভিবাসীদের ওপর গণহত্যা চালানোর আহ্বানও জানিয়েছেন।

এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জার্মানির মূলধারার রাজনীতিতে যে বর্ণবাদী উগ্র-ডানপন্থী মতাদর্শের উত্থান ঘটছে, এ হামলা তারই একটি টুকরো অংশ মাত্র। 

গত কয়েক বছরে সিরিয়াসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। শরণার্থী গ্রহণের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে জার্মানি। আবার বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার প্রভাবও পড়েছে জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আর এটিই ইউরোপে উগ্র-ডানপন্থীদের উত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। 

চাকরি হারানো অসন্তুষ্ট জনগণের সামনে ওই উগ্র-ডানপন্থীরা উপস্থাপন করছে শরণার্থী-বিদ্বেষী, মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তব্য হাজির করছে। আর এসবের মধ্য দিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে বর্ণবাদী মতাদর্শ স্থান করে নিচ্ছে। 

জার্মানিতে ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে উগ্র-ডানপন্থী রাজনৈতিক দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) বিস্ময়কর ফল এ বিষয়টাকে স্পষ্ট করে। যেখানে এর আগের সাধারণ নির্বাচনে এএফডি একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারেনি, সেখানে ২০১৭ সালে তারা ৯৪টি আসনে জয়লাভ করে। আর এ ক্ষেত্রে তাদের নির্বাচনি প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কথিত ‘মুসলিম আগ্রাসন’। এএফডি এ বিষয়টিকে অভিবাসী সংকটের শুরু থেকেই প্রচারে রাখলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে মূলধারার দলগুলো এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, যার ফলে উগ্র-ডানপন্থীরা বর্ণবাদী মতাদর্শকে মূলধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে। 

এএফডির উত্থানের পর মধ্য-ডানপন্থীরাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শরণার্থী-বিদ্বেষী, ইসলামোফোবিয়ার প্রচারণা জোরদার করেছে। আর এমন প্রচারণা কার্যত রাজনৈতিক বিতর্কে বর্ণবাদী মতাদর্শকেই প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করছে, যা টোবিয়াসের মতো হামলাকারীদের জন্ম দিচ্ছে- যারা জার্মানিকে নতুন করে গড়তে চায়, যা হবে শ্বেতাঙ্গদের জার্মানি।

হানাউ শহরে চালানো হামলাকে এএফডি একজন ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ লোকের কাজ বলে প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করলেও, জার্মান সমাজে যে বর্ণবাদ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, এটি তারই নিদর্শন। এটিই প্রথম বর্ণবাদী হামলা ছিল, এমনটিও নয়। এর আগে গত বছর জুনে উগ্র-ডানপন্থীদের হাতে নিহত হন উদারপন্থী রাজনীতিক ওয়াল্টার লুয়েবকে। গত অক্টোবরে হালে শহরে ইহুদিদের একটি প্রার্থনাস্থলের সামনে হামলা চালায় এক উগ্র-ডানপন্থী বন্দুকধারী। এতে দু’জন নিহত হন। আহত হন আরো দু’জন।

বর্ণবাদী রাজনীতির এ উত্থানে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত উদার পুঁজিবাদী রাজনীতি। তাই এর কঠোর সমালোচনাও এসেছে তাদের পক্ষ থেকে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেন, ‘বর্ণবাদ হলো বিষ... আর এটাই এ দেশে সংঘটিত বেশিরভাগ অপরাধের জন্য দায়ী।’ দেশটির প্রেসিডেন্ট স্টেইনমেয়ারও এ হামলার নিন্দা জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। 

তবে হামলার আভাস আরো আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। অভিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও ও অভিবাসী বংশোদ্ভূত নেতারা জার্মান কর্তৃপক্ষকে আগে থেকেই উগ্র-ডানপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তবে সে সময় তা আমলে নেয়া হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরে জার্মান রাজনীতিকরা যে নীতি গ্রহণ করেছে, সেটিও উগ-ডানপন্থী চেতনার উত্থানে সহায়তা করেছে। মুসলিম শরণার্থী ও অভিবাসীদের সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে উঠেছে, তারা আইন মানে না ও সংঘবদ্ধ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত! উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- গত বছরের জানুয়ারিতে এক হাজার ৩০০ জন পুলিশকে সাথে নিয়ে উত্তর রাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে আরব বংশোদ্ভূতদের ঘরে তল্লাশি চালানো হয়। পুলিশের মুখপাত্র অলিভার পেইলার জানান, মূলত সিসা বারগুলোতেই অভিযান চালানো হয়। সিসা বারগুলো নাকি পারিবারিক অপরাধী চক্রের কেন্দ্র।

বার্লিন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেশন রিসার্চের (বিআইএম) গবেষক ওজগুর ওসভাতানের মতে, অপরাধীরা সিসা বার চালাতে পারে, এমনকি কফি হাউস, নাইট ক্লাব, রেস্তোরাঁ বা অন্য কোনো দোকানও চালাতে পারে। কিন্তু সিসা বারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে মুসলিমদেরই এখানে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। অভিবাসী বা শরণার্থীদের মধ্যে অপরাধী থাকতেই পারে। কিন্তু কয়েকজনের জন্য সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে জার্মান রাজনীতিক ও নিরাপত্তাবাহিনী কার্যত উগ্র-ডানপন্থী জাত্যাভিমানের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। এসবই টোবিয়াসের মতো উগ্র-ডানপন্থীদের সিসা বারে হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। 

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রশ্নে তিনি বলেন, মধ্যপন্থী দলগুলোকে অবশ্যই ভোট বাঁচানোর ডানপন্থী প্রচারণার অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। অভিবাসন নীতি নিয়ে বিরোধ থাকলে সে বিরোধ নিয়েই বলতে হবে। এ বিরোধের জের ধরে অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ উগড়ে দিলে আজ হয়তো তারা ভোট বাঁচাতে পারবেন; কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে নিজেদের অস্তিত্বটুকুই হারাবেন উগ্র-ডানপন্থীদের কাছে, যা জার্মান সমাজকে বর্ণবাদ, ইসলামোফোবিয়া ও জাতি-বিদ্বেষের উর্বরভূমিতে পরিণত করবে। যেখানে উত্থান ঘটবে নব্য-নাৎসিবাদের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //